Thursday, April 24, 2025

ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্রাজেডির এক যুগ জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হতাশা কাটে না ভুক্তভোগীদের, বিচারে ধীরগতি


 রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার শেষ হয়নি এখনও। এ ঘটনার তিনটি মামলার একটি উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে আছে। সাক্ষী না আসার কারণে অন্য দুটির বিচার চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতার অভিযোগও উঠছে।

বর্তমানে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ১৫ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল, কিন্তু সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন আগামী ১৯ মে।

রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, সাক্ষীদের ডাকলেও তারা অনেকে আসছেন না। এমনকি আদালত থেকে সমন জারি করে, পুলিশ পাঠিয়েও অনেক সাক্ষীকে হাজির করতে হয়েছে বলে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, মোটামুটি ১০০ জনের সাক্ষ্য পেলেই তারা মামলার কাজ শেষ করতে পারবেন। দ্রুতই তা শেষ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তারা।

অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী বরাবরই দাবি করে আসছেন, জমির মালিক হিসাবে সোহেল রানার বাবা-মায়ের নাম তাকে জামিন দেয়া উচিত। আসামীর আইনজীবীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল ভবন মালিক সোহেল রানাকে জামিন দেন হাইকোর্ট। তবে পরবর্তীতে সেই আদেশ স্থগিত করে আপিল বিভাগ।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের পোশাকশিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডির বিচার নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। হাজারো ভুক্তভোগী শ্রমিক ও হতাহতের পরিবারে দেখা দিয়েছে হতাশা।

বিচারের ধীরগতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হতাশা প্রকাশ করে আসছেন আহত শ্রমিক এবং অধিকারকর্মীরা। রানা প্লাজা ধসকে দুর্ঘটনা নয়, বরং 'কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড' বলে দাবি করে আসছে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১২ বছর

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ এ সাভারে একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্কবার্তা থাকলেও তা উপেক্ষা করার কারণেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ হাজার ১৩৬ শ্রমিক। পঙ্গুত্ববরণ করেন ১ হাজার ১৬৯ জন। জীবিত উদ্ধার করা হয় প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে। এছাড়া অতি মুনাফার লোভই এর আসল কারণ বলে মনে করেন অনেকেই। রানা প্লাজা ধসের ঘটনার ১২ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল)।

গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতার বলেন, ‘বাংলাদেশের মালিক (কারখানার), সরকার বা বিদেশি ক্রেতারাও শ্রমিকদের মনে করতেন অনেকটা মেশিনের মতো। তারা শুধু কাজ করবে, তাদের কোনো স্বপ্ন থাকবে না। তাদের কোনো পরিবার থাকবে না। এই যে ভাবনা, যে তারা মালিকদের জন্য পণ্য তৈরি করবে আর তাদের মুনাফার আয়োজন করবে, সেটাই মূল সমস্যা।’

২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার যখন নিজে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে সাহস পাচ্ছিলেন না, ভবন মালিক রানা 'সামান্য প্লাস্টার খসে পড়েছে', 'ঝুঁকিপূর্ণ কিছু না' বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। স্বয়ং ইউএনও যখন ভবন মালিকের সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, 'তেমন আশঙ্কার কিছু নেই', তখন আসলে শ্রমিকদের আর কীই বা করার থাকতে পারে।

রানা প্লাজায় অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের মন্তব্যেই স্পষ্ট, কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছিল। আগের দিন ফাটল দেখা দেয়ার পরদিন কারখানা ছুটি দেয়া হয়। পরদিন তাদের অনেকেই ভয়ে আর কাজ করতে চাচ্ছিলেন না। মাসের ২৪ তারিখ। আর এক সপ্তাহ পরই হয়তো বেতন হবে। বেশিরভাগ শ্রমিকেরই বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে সব খরচের একমাত্র জোগান এই পোশাক কারখানার চাকরি। ২৪ তারিখ সকালে যারা রানা প্লাজায় ঢুকতে চাচ্ছিলেন না, তাদের হুমকি দেয়া হয় কাজ না করলে বেতন আটকে রাখার। ফলে অধিকাংশ শ্রমিকই বাধ্য হন কাজ শুরু করতে।

বিশ্বের ইতিহাসে রানা প্লাজা ধস ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ওই ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক।

বিশ্বের ভয়াবহতম শিল্প দুর্যোগের একটি হিসেবে এরই মধ্যে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ওই ভবন-ধসের ঘটনা। ভয়াবহ ট্র্যাজেডির এই ঘটনা গোটা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল।


শেয়ার করুন