Friday, April 25, 2025

দালাল সিন্ডিকেটে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস: সেবার স্থলে দুর্নীতির দুর্গ


 কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে সেবা এখন কেবল কাগজে-কলমে। বাস্তবে এটি যেন এক দুর্ভেদ্য দুর্গ—প্রবেশ করতে হলে দরকার দালাল ও ‘বিশেষ কর্মচারীদের’ অনুমতি। অভিযোগ রয়েছে, এ অফিস পরিচালনায় নিয়োজিত সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। তার ছায়াতলে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন অফিস সহকারী মো. মামুন, যিনি দুর্নীতির সরাসরি অংশীদার।

জানা গেছে, মোবারক ও মামুনের বিরুদ্ধে রয়েছে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট বাণিজ্য, ঘুষ লেনদেন, সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি এবং অপমানজনক আচরণের মতো একাধিক অভিযোগ। যা নিয়ে ভুক্তভোগীরা প্রায়শই ফেসবুকে ক্ষোভের পোস্ট দিচ্ছেন। তবে এসব মানুষের অশ্রু আর নিরব আকুতি যেন ঠেকে না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হৃদয়ে— এমনকি মাত্র কয়েকশ গজ দূরে অবস্থিত দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যালয়ও রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ থাকে।


রাজনৈতিক একটি সূত্র জানিয়েছে, বিগত সরকারের এক প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার সরাসরি তদবিরে মোবারককে কক্সবাজারের মতো রোহিঙ্গা অধ্যুষিত স্পর্শকাতর জেলায় পোস্টিং দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট- এই অঞ্চলের অরাজক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে একটি টাকার খনি হিসেবে ব্যবহার করা।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেনের চারপাশে ঘিরে আছে কয়েকজন নির্দিষ্ট কর্মচারী- তাদের মাধ্যমেই চলে অফিসের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ। অন্য কোনো কর্মী স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলে তাদের উপর নেমে আসে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বদলির আবেদন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, অফিসের অভ্যন্তরে নিয়মিত চলে কোটি টাকার রোহিঙ্গা অবৈধ পাসপোর্ট বাণিজ্য, নারী হয়রানি, হুমকি-ধামকি আর প্রতিটি পদক্ষেপে দুর্নীতির বিষবাষ্প। আর এই মহা-অপকর্মের মূল কুশীলব- সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন। যাকে সরকারি নম্বরে ফোন করলে সাড়া মেলে না, দরকার হলে হোয়াটসঅ্যাপে দালালদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সাধারণ মানুষের কপালে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরও ‘আজ আসেন, কাল আসেন’ টাইপের জুলুম।

জানা গেছে, অফিস সহকারী মো. মামুনও এই দুর্নীতির সিন্ডিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সহকারী পরিচালক মোবারকের ছত্রছায়ায় তিনি বছরের পর বছর ধরে একই পদে বহাল থেকেছেন। সময়ের সাথে সাথে মামুনের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট সিন্ডিকেট ও দালালচক্রের সঙ্গে। এরপর থেকেই মোবারক-মামুন জুটির সমন্বয়ে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস পরিণত হয় এক গোপন দুর্নীতির খনিতে- যেখানে প্রতিটি আবেদনপত্রের নিচে জমা পড়ে ঘুষের স্তর, আর ফাইলে যদি ‘বিশেষ চিহ্ন’ না থাকে, তাহলে তা ফেরত যায় অপমান ও গালাগালির সঙ্গে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, 'মামুনের গায়ে শার্ট, চোখে চশমা- দেখলে মনে হয় একেবারে ভদ্র, মার্জিত একজন অফিস সহকারী। কিন্তু একটু কাছ থেকে দেখলেই বোঝা যায়, বাইরের এই সাজানো চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর রূপ। তার আচরণে এমন এক আগ্রাসী রুঢ়তা, যা দেখলে মনে হয়- সে যেন কোনো বেদুইন জানির সন্তান, সভ্যতা-ভব্যতা তার ধারে কাছেও নেই।'

তাদের মতে, 'দালালের মাধ্যমে না গিয়ে যদি কোনো সাধারণ মানুষ সরাসরি সেবা নিতে চায়, তখন তার চোখে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, এমনকি অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে- যা কোনো সরকারি কর্মচারীর মানসিকতা হতে পারে না।'

নুরুল আবছার নামের এক যুবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'একজন অসহায় নারী দিনের পর দিন ঘুরেও পাসপোর্ট পাচ্ছিলেন না, কারণ তিনি ঘুষ দিতে পারেননি। তাঁর চোখের পানি দেখে আমি আর চুপ থাকতে পারিনি। সাহস করে বিষয়টা নিয়ে এডি মোবারকের রুমে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে যা শুনতে হল, তা কোনো মানুষ সহ্য করতে পারে না। আমাকে অকথ্য গালাগালি করে, কুকুরের মতো রুম থেকে বের করে দেন তিনি। সেই মুহূর্তটা বারবার মনে পড়ে... অপমানটা এমন গায়ে লেগেছে যে, মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করলেই বুঝি মুক্তি মিলবে।'

ইমাম হোসেন সুমন নামে আরেক যুবক বলেন, 'সত্যি কথা বলতে কী, এই অফিসে মামুন এখন ‘রাজার’ ভূমিকা পালন করছে। এডি মোবারকের ছত্রছায়ায় তার ক্ষমতা যেন আইনের ঊর্ধ্বে। সেবা নয়, মানুষ যেন তার করুণা নিয়ে বাঁচে। এই অবস্থা চলতে থাকলে শুধু প্রশাসনের নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরই প্রশ্ন উঠবে।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হতভাগা ভুক্তভোগী বলেন, 'আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার পাসপোর্ট দরকার। কিন্তু অফিসার স্যারের দেখা পেতে ৩ দিন ঘুরেছি। যখন দেখা পেলাম, উনি আমার মুখের উপর বললেন ‘এইসব মামুলি কেস নিয়ে আমার কাছে আসো কেন?’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি রোহিঙ্গা পাসপোর্ট অনুমোদনের পেছনে ঘুষের পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। এই পুরো দুর্নীতির সাম্রাজ্যের মূল শক্তি অফিস সহকারী (কাম কম্পিউটার) মো: মামুন। ফরম জমা রুমে বসেই তিনি ঠিক করেন কে পাসপোর্ট পাবে, আর কে ফিরবে অপমান নিয়ে। দালালের চিহ্ন না থাকলে রীতিমতো গালাগাল করে ফাইল রিজেক্ট করে দেন। সাধারণ মানুষের জন্য থাকে অবজ্ঞা, আর রোহিঙ্গাদের জন্য থাকে ‘ভিআইপি শর্টকাট রুট’।

অনুসন্ধান ও সূত্র বলছে, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা গণি হলেন রোহিঙ্গা পাসপোর্ট বাণিজ্যের অন্যতম লিংকম্যান। তার লোক পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকায় রোহিঙ্গা পাসপোর্ট বানান মামুন, যার মোটা অংশ যায় এডি মোবারকের পকেটে। আর অফিসের সামনের দোকানদার মারুফ হলেন মামুনের ছায়াসঙ্গী। তারা দুজনে মিলে ৫০ লক্ষাধিক টাকার জমি কিনেছেন কক্সবাজার বাস টার্মিনাল এলাকায়। অথচ তাদের বৈধ আয়ের উৎস আজও প্রশ্নবিদ্ধ। কথিত আছে, মারুফের ব্যাংক ব্যালেন্স ৫ কোটি টাকার ওপরে। গতবছর তার দোকানে সিভিল সার্জনের জাল সিল ও স্বাক্ষরসহ সার্টিফিকেট তৈরি করার অভিযোগে জেলা প্রশাসন সিলগালা করে দেয়- কিন্তু কিছুদিন পরেই সব আগের মতো ‘স্বাভাবিক’ হয়ে যায়।

এইসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে সরাসরি তার অফিসে গিয়েও দেখা করা সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি সাক্ষাৎ দেননি।

অভিযোগগুলোর বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নুরুল আনোয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে মোবারক হোসেনের দুর্নীতি ও অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়গুলো লিখিতভাবে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

তবে ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।



শেয়ার করুন